কোনিয়া।। কন্যা কফি ক্যারিশমা
কোনিয়া।। কন্যা কফি ক্যারিশমা
মাহমুদ হাফিজ
কফির চুমুক শেষ করে কোনিয়াকন্যা তুবা হিলাল
ঝট করে ওসমানীয় কেতায় চিত্রিত কাপটি পিরিচের ওপর উল্টে ফেললো। দীঘল মায়াবী চোখের আলো
আমার চোখের ওপর ফেলে বললো-
আমি বিয়ে করবো
না। সে আগ্রহও আমার নেই। তবে তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। তুরস্ক ভ্রমণ তোমার ফলবতী হবে
!
ভ্রমণসঙ্গী গৃহবন্ধূ জলি সব ভ্রমণের মতোই
‘বলেছিলাম না,
আমি থাকলে তোমার সব ভ্রমণ ভালো হয়’- বলে বসা অবস্থা
থেকে গাত্রোত্থান করলো।
আমি হতভম্ব! ভাবলাম,জলি ফলবতীই, ভবিষ্যত
সম্ভাবনা জিরো। কোনিয়াকন্যা, তুমি জীবনে বিয়ে
না করলে ভ্রমণ ফলবতী কি করে হবে !- ভাবনার মধ্যে এই কফিকথনের প্রসঙ্গ-পরম্পরা বুঝতে
পারি না। তার্কিশে না, ঝরঝরে ইংরেজিতেই বলে যাচ্ছে সে।
ভ্রমণবন্ধু তুবা হিলালের মধুর সঙ্গ ও রেহবারির
বিশেষ ভঙ্গিকে সঙ্গী করে মেভলানা মোহগ্রস্থ তার্কিশ নগরী কোনিয়া ভ্রমণ করছি। তুরস্ক
ভ্রমণকালে কোনিয়া যাবো, এমন পরিকল্পনা আমার ছিল না। পরিকল্পনার কারুকার মসয়ূদ মান্নান।
দু’জাতির সম্পর্কোন্নয়নে
দূতিয়ালিতে নিয়োজিত তিনি দীর্ঘদিন। আঙ্কারা, আন্তেপ, আফিয়নকারাসিসার না কোনিয়ায় থামাতে
হবে আমার ভ্রমণরথ, তা তার ভাল করে জানা। মান্যবরের কোনিয়া বাঁশিতে তবলার তাল সঙ্গত
করেছেন সাকিনেরই ভূমিকন্যা ডেনিস বুলকার। কতো যে কীর্তিমতির গুণপনা তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
ভ্রমণনাচে আমরাও নাচি তাধেই ধেই্। সুরতাললয়ে
ভালোবাসার শেমা নৃত্যনগরী কোনিয়াভ্র মণ হয়ে ওঠে জবরদস্ত এক। কয়েকদিনে নগরী ও উপকন্ঠের
জনপদ দেখে আমরা দর্শনমুগ্ধ, ভ্রমণতৃপ্ত। সহসাই ভ্রমণসঙ্গ সাঙ্গ হতে যাচ্ছে বলে আজ সবার
মন বিষন্ন, অন্যমনস্ক। সুফিজমের আধ্যান্তপ্রান্তরে পরস্পরের প্রতি টান, অনুভব ও অজানা অনুরাগ কম হয়নি
এ ক’দিন। হৃদয়পকেটে
কি তবে জমা হয়ে আছে কারও অব্যক্ত কথকতা? সবসময় সব জিজ্ঞাসার জবাব দেয় না হৃদয়। উত্তর
চাওয়াও সমীচীন না। রোমান্টিসিজমের আকাশ থেকে ভূতলে নেমে দেখি, ভরজীবনের ভ্রমণবন্ধু
জলি এ পরিব্রাজনে। পৃথিবীর পাঠশালার বোহিময়ানকে কোনিয়াকোণ নিয়ে থাকলেও চলে না। ‘হেথা নয় অন্য
কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে’ বলে রবীন্দ্রভাবনা ভাবার সময় এখন। দরজায় অপেক্ষমান
তুর্কি প্রদেশ আফিয়ন কারাসিসার।
তুবা হিলাল নগরতরফে এখানে আমাদের ভ্রমণ
গাইড, তুর্কিতে বলে ট্যুরিস্ট রেহবারি। প্রিয়জনের মতো আন্তরিকতা আর নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের
মতো সে যেভাবে দর্শন করালো সব, এ লেখায় ভ্রমণবন্ধু বললেই বেশি মানায় তাকে। ট্যুরিস্ট
রেহবারির রীতি অনুসারে আমাদের দিনমানের যাতায়াত, খানা খাদ্যের খরচাপাতি এই কোনিয়াকন্যার
পার্সেই। উদারহস্তে তা খরচও করে চলেছে সে। ক’দিনের কোনিয়ায়
তার অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠতা, উজাড় করা ইতিহাসজ্ঞান, গবেষণালব্ধ ঐতিহ্যসম্পদের কতোকিছূ যে
মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি তার হিসেব নেই। এখন তাকে এক পেয়ালা কফি পান করানোই ভ্রমণভদ্রতা
! বেড়ানোর দীর্ঘতালিকার শেষ দিকে এসে তাই কফির প্রস্তাব দিই।
আমাদের ভ্রমণভূগোল এখন সেলজুক বংশোদ্ভূতদের
নিবাসখ্যাত সেলজুক জেলার একদাত পার্কে। সেলজুক সুলতানরা আনাতোলিয়ার ক্ষমতায় আসীন হয়ে
কোনিয়াকে শুরু থেকে রাজধানী ঘোষণা করেছিল। সেলজুক, অটোম্যানের কিছু নির্দশন দেখার পর
খোলা চত্ত্বরে হাঁটছি। পার্ক বলতে পার্ক নয়। পূর্বপুরুষের সময় ও শাসন চেনাতে নতুন প্রজন্মের
জন্য গড়ে তোলা এতিহ্যস্থাপনা। ‘কোনিয়া বুয়ুকসেহির বেলায়েদেসী’- বা কোনিয়া মেট্রোপলিটন
মিউনিসিপ্যালিটি নির্মাণ করেছে দিনমানের এই ভ্রমণস্পট। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, নামাজগাহ
ঝর্ণা, অটোম্যান স্ট্রিট, অটোম্যান ক্যাফে, টাওয়ার ক্যাফে, কৃত্রিম লেক, বসফরাস ম্যানসন,
সেলজুকদের সহস্রবর্ষী সদর দরজা, প্রাচীনকালের
ব্যবহার্য জিনিসে ঠাসা স্যুভেনির শপ, দূর্গ আদলের মডেল পোতাশ্রয় নিয়ে নির্মিত সুবিশাল
এলাকা। চালূর পর থেকেই এই একদাত তরুণ-তরুণী, ঐতিহ্যচেতন দম্পত্তি ও প্রেমিকযুগলের আগ্রহের
কেন্দ্রে।
ওসমানীয় স্থাপত্যের বাড়িগুচ্ছ- ‘পার্ক হাউজ’ দেখে আমরা হাজার
বছর আগের দিনে ফিরে যাই। দুপাশে কাঠের কারুকাজময় পুরনো স্থাপত্যের দালান সারি। দালানে
দালানে নকশা কাটা কাঠের দরজা। ভিতরে স্যুভেনির শপের তাক লাগানো জগৎ। চত্বরজুড়ে ফাঁকে
ফাঁকে বেঞ্চ। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে কয়েক মধ্যবয়স্কা রঙিন সুতোর টুপি বুনছেন। তুর্কিজাতির
পূর্বপুরুষের জীবনযাপন জীবন্ত করে তুলছেন এই তিন নারী। ঘুরে ঘুরে স্যুভেনির দেখি তিনজন।
মেভলানার টুপির জন্য ঢাকা থেকে ভ্রামণিক সৈয়দ জাফরের অনুরোধে ছিল। পেয়েও যাই। বড় সাইজ
ও বহন অসুবিধাজনক বিবেচনায় শেষমেষ কেনা হয় না।
সেলজুক দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই সম্মুখে
বিশাল হ্রদ। চারপাশ জুড়ে স্থাপনা। পানির ওপর গা চুবিয়ে দর্শনার্থীদের বেশি নজর কাড়ছে
বসরফরাস ম্যানসন আর অটোম্যান কেতার ক্যাফে ‘ওসমানলি কাভহে
হানেসি’। তখনই আচম্বিতে
হন্টনসঙ্গীকে আমার কফিপ্রস্তাব। লম্বা ফর্সা গ্রীবা বাঁকিয়ে অনায়াসে সায় নিমন্ত্রিতের।
ট্যুরিস্ট রেহবারির বিশেষ ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে ভুগোল ইতিহাসের পাঠ দিতে দিতে পাশাপাশি
হাঁটতে থাকে সে। বিগত কয়েকদিনের চেনা এই হস্তভঙ্গিমা। মুগ্ধশ্রোতা হয়ে পা চালাই। গিয়ে
বসি অটোম্যান ক্যাফে তে।
আমার কফিপ্রস্তাব আদতে সরল সৌজন্যেভরা।
হলে কি হবে, কোনিয়াকন্যা নিয়েছে তা পরম যত্নে, ভালোবেসে। কাজে সিনসিয়ার, মননে আন্তরিক-
দেখা হওয়ার আগেই বুঝেছিলাম তার চরিত্রগুণ।
এখন পলে পলে বুঝতে পারছি। মান্যবরের অধীন কর্মকর্তা কেমাল দুগকান অভিজ্ঞহাতে ভ্রমণসূচি
চূড়ান্ত করেছেন। রাজধানী আঙ্কারা থেকে কোনিয়া রেলপথে যেমন নদী খাল পর্বত মালভূমি উপত্যকার
চমক, তেমনি সূচির প্রতিটি আইটেমে আছে ভ্রমণচমক। আঙ্কারা উপকন্ঠের পর্ব্বতশহর ‘বেপাজারি’ তুর্কিমিষ্টান্ন
বাকলাভার সূতিকাগারখ্যাত। এখানকার হৃদয়হরা মিষ্টি মেয়েদের হাতছানি আত্মস্থ হওয়ার আগেই
আসন নিতে হয় আঙ্কারা-কোনিয়া হাইস্পিড ট্রেনে। নবেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে পৌণে দু’ঘন্টার কোনিয়া
যাত্রায় যখন জাবর কাটতে যাবো সদ্য ঘুরেআসা বেপাজারির, তখনই টুং শব্দে ভেসে ওঠে হোয়াটসআপ
বার্তা: ‘আই এ্যাম তুবা,
ইওর গাইড ইন কোনিয়া’…। প্রথম পরামর্শটিও ভার্চুয়ালি আসে। আমার শহরে যেমন
কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া কোর্ট নামে দুটি রেল স্টেশন, দিল্লিতে যেমন নয়া দিল্লি,েদিল্লি
ফোর্ট-কোনিয়ানগরেও তেমনি রেলস্টেশনের সংখ্যা দুই। বার্তা না পেলে টিকেটে স্টেশনের নাম
দেখেই নেমে যেতাম ভুলস্টেশনে। মুহুর্তে হয়ে যেতাম বেনামা পথের বেগানা পথিক। পেশাদার
গাইডের বুদ্ধিমত্তায় আঙুলে টাইপ করা কয়েকটি শব্দ পেরেশানি উধাও করে মেজাজ ফুরফুরে করে
দেয়। গুণগুণ করে গান মিশিয়ে দিই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে থাকা ট্রেনের গতির শব্দে।
এই মেজাজে গন্তব্যে পৌঁছে দরজামুখেই যখন পেয়ে যাই তুর্কি তরুণীর হাসিমাখা মুখচ্ছবি,
তখন আর সঙ্গী জলি ছাড়া পায় কে আমায়?
তুর্কিসমাজে তন্বী তরুণীকে কফিপানের অনুরোধ
সাদামাটা জিনিস না। যেন প্রেম-প্রণয়িনীকে ডেটিংয়ের আহবান। যে দেশে সমাজ রীতি থেকে রাজনীতি,
গ্রাম্যকূটির থেকে রাজপ্রাসাদ তক কফিরাজত্ব। যেখানে প্রেম-প্রণয়ের ভুতভবিষ্যত বিবেচনা
হয় কন্যার কফি ক্যারিশমা আর কফি কাপের তলানিরেখা গুণে। সেখানে তুর্কিসুন্দরীকে কফি
পানের নিমন্ত্রণের আগে সাত বার ভাবা প্রয়োজন।
পরে বুঝতে পেরে লজ্জায় আমার কাটা যাচ্ছে
!
মেভলানা কী! খোলাসা করে নেয়া ভাল। তুরস্কে
মেভলানা হচ্ছে- মসনবীখ্যাত ত্রয়োদশ শতাব্দীর পারস্য কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি।
সুফিজম, ভালোবাসা ও দর্শনের অমর কিংবদন্তি। আমার প্রাণের শহর কুমারখালী, কুষ্টিয়ার
পথপ্রান্তর যেমন বাউল লালনের উদাসী সুরে মাতাল, কোনিয়া তেমনি অনির্বচনীয় মাওলানামোহে
মাতোয়ারা। না দেখলে বোঝার উপায় নেই, এ যুগের এক আধুনিক নগরী কতোটা মাওলানা-মাতাল।
নগরীর জাদুঘর-পাঠাগার, মসজিদ-গির্জা, স্কুল-মাদ্রাসা,
হোটেল রেস্তোরা, রাস্তা-এভিনিউ, দোকান পসারে মেভলানা-আমেজ, তার নামেরই জয়গান। জাদুঘর
দেখতে চাইলে নগরবাসী মেভলানা মিউজিয়াম দেখিয়ে দেয়। স্যুভেনির কিনতে চাইলে দোকানী চোখের
সামনে মেলে ধরে জালালুদ্দিন রুমি ব্যবহৃত বিশেষকেতার সবুজ টুপি, শেমা নৃত্যভঙ্গির মিনিয়েচার।
ভ্রমণেচ্ছু হতে গেলে ট্যাক্সিচালক জিজ্ঞাসুনেত্রে উচ্চারণ করে ‘মেভলানা’? গণপরিবহণের
হেলপার ‘মেভলানা’, ‘মেভলানা, বলে
দিনমান হাঁক ডাক দেয়। নগরকেন্দ্র মানেই মেভলানা এভিনিউ, মেভলানা স্কয়ার। ভাল রেস্তোরাঁ
মানে মেভলানা রেস্তোরাঁ। আশ্চর্য হই, নগরজীবনের সঙ্গে এখনও মিশে আছেন আধ্যাত্মসাধক
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি। ধর্মবর্ণের উর্দ্ধে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে স্রষ্টা সন্ধান
ছিল যাঁর সাধনা ও শেমা ঘুর্ণননৃত্যের ভিত্তি। না দেখলে বিশ্বাস হবে না, আটশ’ বছর আগের সুফি
কবির আধ্যাত্মচেতনায় কতোটা প্রোথিত নগরজনের মন! একেই বলে অমরত্ব ! সৃজনশীল মানুষ অমরত্ব
আকাঙ্খী। তুর্কি জাতির স্মরণ-তপর্ণে মেভলানা রুমি ঈর্ষণীয় অমরত্ব লাভ করেছেন বলে অবাক
হয়ে হই।
‘ওসমানলি কাভহে
হানেসি’তে রাজকীয় কেতার
কফির দাম একটু বেশিই। কাপপ্রতি বিশ লিরার কফি অর্ডার দিয়ে অপেক্ষার অবসরে আমি ইতিহাসের
ছবক নিতে থাকি। সেলজুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষার্থী-গবেষক তুবা কোনিয়া উপকন্ঠের
প্রত্নশহর ‘চাতালহুক’ এর কথা উল্লেখ
করে ইতিহাসপৃষ্ঠা উল্টাতে গলদঘর্ম হয়। চোখ এড়ায় না, ফর্সা মুখায়বয়বে লম্বা নাক ঘামে
ভিজে ওঠে তার। কথা থামিয়ে সলজ্জ হয়। ওয়েটারের সাজিয়ে যাওয়া ‘ওসমানলি’ নামাঙ্কিত রুমালে
ত্রস্তহাতে মুখ মুছে ফের ইতিহাসে মন দেয়। জগতে
বহু মানুষ আছে, যাদের মুখশ্রী ও কথার বলার
ভঙ্গি অন্যকে আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। কোন অংশ কম নয় বলে ট্যুরিস্ট রেহবার হিসাবে
মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে সুনাম আছে তার। অর্ধশতাধিক রেহবারের মধ্যে তার কদর একটু বেশিই।
ভ্রমণকালে কথায় কথায় ভ্রমণবন্ধু তুবা আগেই
জানিয়েছে, পড়াশুনা- গবেষণার ফাঁকে রেহবারি তার অবসরের আনন্দ। বিনোদনের সঙ্গে রোজগারের এর চেয়ে ভাল
উপায় তার জানা নেই। তবে এ আয়োজনে দেশবিদেশের আকছার রেহবারকে হ্যান্ডেল করতে হয় বিপত্তিও
কম হয় না। নানা কিসিম, নানা তরিকা নানা বয়সপেশার মুসাফির আসে কোনিয়ায়। ঘুরতে ঘুরতে অনেকসময় মনের ওপর চাপ তৈরি হয়। দিনশেষে সে জ্ঞানান্বেষী
ও ভ্রমণপ্রিয় যেমন, তেমনি আবেগী মন ওলা এক মানুষই তো, রোবট নয় !
চোখ এড়ায়নি আমাদের ভ্রমণসঙ্গ যতো সাঙ্গ
হওয়ার দিকে যাচ্ছে, ততোই তার ই্উরোপীয় স্টাইলের পরিচ্ছদ পরিগ্রহ করছে মুসলিমীকেতা।
আজ সে পরে এসেছে বাংলা-ভারতের মুসলিম নারীদের প্রিয় সালোয়ার, কামিজ, ওড়না। এ ক’দিন কোনিয়ার প্রতিটি
কোণ থেকে উচ্চকিত হয়ে ওঠা আজানের সময় যার কোন হেলদোল দেখিনি, আজানের শব্দে আমার জীবনবন্ধুর
মতো মাথায় ওড়না পেঁচানো দেখি এখন। ভারত-বাংলার মেয়েরা পরপুরুষের সামনে যতোটা শালীন,
ক্রমশ সে হয়ে উঠছে তারচে এককাঠি সরেশ। ভাবি, অদ্ভুত এই পৃথিবী, আরও অদ্ভুত হিউম্যান
সাইকলোজি !
সুনাম ধরে রাখতে অটোম্যান ক্যাফে তার্কিশ
কফি সুবিচার করেই বানায়। আধঘন্টার আগে কফি আসবে বলে মনে হচ্ছে না। অপেক্ষার অবসরে আমাদের
ইতিহাসপাঠ এগিয়ে চলে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের পর গ্রীক, রোমান, বাইজেন্টাইন, সেলজুক, অটোম্যান
সভ্যতা পার করে এসেছে এ নগরী। এশিয়া মাইনরে
আনাতোলিয়া নামের যে বিশাল ঐতিহ্যরাষ্ট্রের কল্পচিত্র ইতিহাসচেতন মানুষের মনে আঁকা,
আগে তার ইতিহাস ছিল মোটামুটি চারহাজার বছরের। জুমরা জেলার ‘চাতালহুক’ জনপদে ইউনেস্কোর
প্রত্নখননের পর সব হিসেব উল্টে গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, কোনিয়ায় মিলেছে মানবেতিহাসের
প্রথম শহুরে সভ্যতার প্রমাণ- যা কালের বিচারে সাড়ে নয় হাজার বছরের পুরনো। বর্তমান প্রজন্মের
জন্মের সহস্র বছর আগে বাইজেন্টাইনদের পরাভূত করে এগারো শতকের শেষে সেলজুক সম্রাটদের
আগমন ঘটে ইতিহাসনাট্যে। আনাতোলিয়াকে কেন্দ্রে রেখে তারা রুম সালতানাত নামের মুসলিম
সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, কোনিয়া শুরু থেকেই ছিল রোম সালতানাতের রাজধানী। প্রায় দশহাজার
বছরের ইতিহাসস্পর্শী নগরী আধুনিক তুরস্কে কোনিয়া প্রদেশের রাজধানী এখন। তুরস্ক করে
দাবি করে আনাতোলিয়া অঞ্চল মানবসভ্যতা ও ইতিহাসের সুতিকাগার।
ইতিহাসপাঠ সেলজুক সুলতান তুঘরিল, বাইজেন্টাইন
সম্রাট কনস্টান্টিন আর অটোম্যান সুলতান প্রথম ওসমান পর্যন্ত আসতে না আসতেই আমাদের কফি
চলে আসে টেবিলে। ক্ষুদ্র কাপে,গভীর কালো,ধুমায়িত কফি। মাদকতাময় তার কড়াগন্ধ। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ মনে হয়। কাপ তুলে চুমুক দিতে
গেলে তুবা খপ করে আমার ওষ্ঠে উত্থিত হাত চেপে ধরে।
ওহ নো, ইট ইজ
ভেরি হট। তুর্কিশ কফি পান করতে গিয়ে বেশিরভাগ অনভ্যস্থ ওষ্ঠ পুড়িয়ে ফেলে।
ধোয়া ওঠা কৃষ্ণবর্ণ কফি ঠান্ডা হওয়ার অবসরে
তুবা কফি কাহিনী চালিয় যায়।
আমার মনে পড়ে, কৈশোরে শুক্রবার জুম্মার
দিন কিংবা রোজার সময় তারাবাহি নামাজে কোন বাড়ি থেকে মিলাদের শিরণি, মিষ্টি আসতো। জিলাপী,
চিনির খাজা, মুড়কি, মুড়ি এসব। মিলাদ অন্তে সেই শিরনি সামনে রেখে মৌলভী হুজুর সুললিতকন্ঠে
লম্বা মোনাজাত করতেন। আমদের বাচ্চাদের মন পড়ে থাকতো শিরণিতে, ভাবতাম এই অনন্তকালের
মোনাজাত কখন শেষ হবে। দোজাহানের নেকী হাসিল করে পুলসিরাত পাড়ির মোনাজাত সহজে থামতো
না। আজ তেমনি কফি সামনে রেখে কফিবৃত্তান্ত শুনছি ভ্রমণগবন্ধুর অপূর্ব বয়ানে। তুবা বলে
চলে-
জানো তো, কফি
এ দেশের জীবনসংস্কৃতির অংশ। আসল তার্কিশ কফি বানাতে ইবরিক নামের চওড়াতলা আগাচিকন হাতলওলা
ঘটে পানি নিতে হয়। আধভাজা কফি গুঁড়ো পানিতে মিশিয়ে তপ্ত বালির ওপর বসিয়ে দেয়া হয়। প্রচন্ড
তাপে কফির কড়া গন্ধ যেমন বাতাসে ছোটে, তেমনি তা দেখতে হয় কালোর উপরিভাগে ফেণিল খয়েরি।
অটোম্যান কাপেই তা পরিবেশনের রেওয়াজ।
এখন যে কাপে কফি
এসেছে এর নাম ‘কাভহে ফিনঝাঙ। এই কাভহে জিনিসটাই তার্কিশ ভাষায় কফি.
ফিনঝাঙ হচ্ছে কাপ।
তার মানে তোমাদের
কফি ঐতিহ্য লিটারেচারে জায়গা পাওয়ার মতো !
আরে পাগল! লিটারেচার
কী! কফির ওপর ঢাউস বইপত্র, ডক্যুমেন্টারি, থিসিস সবই আছে। বরের পরিবার কনে দেখতে এসে
কফি পরিবেশন দেখে কনের গুণ বিচার করে।
ইতোমধ্যে ওষ্ঠ না পোড়ার মতো শীতল হয়েছে
কফি, কিন্তু চুমুক দিয়ে আমি উষ্ণ হয়ে উঠছি। কফি নিয়ে যখন এতো লিটারেচার, তাহলে আরও
কিছূ শোনা যাক না !
মধ্য নবেম্বরের শান্ত বিকেলের ম্লান আলো
কৃত্রিম হ্রদের জলরাশিতে ঠিকরে পড়েছে। সেখানে এক দৃষ্টিনন্দন মায়া। ঘুরতে আসা ঐতিহ্যপ্রাণ
দম্পত্তি ও প্রণয়াঙ্খী যুগোলদের প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে বিকেলের হলুদাভ আলোয়। দর্শনীয়
এলাকা ঘুরে তারা এখন জিরোচ্ছে অটোম্যান ক্যাফের কফিবিশ্রামে। কোনিয়াকন্যা, কফি ও কফি
ক্যারিশমার গল্পে আমাদের বিষন্নতা কেটে গেছে। ক্যাফেইন শরীরকে চাঙ্গা আর কফিগল্প মনকে
আনন্দে ফুরফুরে করে তুলেছে।
ওসমানীয়দের অনুকরণে কাঠের কারুকাজের চৌচালা
ঘরবিশিষ্ট ক্যাফেটি। ভেতরে ছাদের নিচে গাঢ় খয়েরি রঙের নকশা, কারুকাজ। ছাদ থেকে নেমে
এসেছে দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি। মধ্যখানে শ্বেতপাথরের বর্গাকৃতি সুদৃশ্য ঝর্ণা। নিরন্তর উপচানো পানি পড়ছে নিচে তৈরি চৌবাচ্চায়। সম্মুখভাগে
রাস্তা ও প্রবেশপথ। বাকি তিনদিক কৃত্রিম হৃদের ওপর ঝুলন্ত। লেকঘেঁষা জানালাগুলোতে বাহারী
পর্দার রাজকীয় জৌলুস। জানালার ওপর থেকে ছাদ অবধি কাঠ ও রঙিন কাঁচের খোপ। তুর্কি ভ্রমণে
এরকম কারুকাজ অনেক মসজিদ-মাজারে দেখেছি বলে অনেকটা চেনাই লাগছে। হ্রদ ঘেঁষে বৈঠকীঢঙে
পাতা অনুচ্চ সোফা। ভেতরেও মধ্যে মধ্যে গোলাকার টেবিল ঘিরে অনুচ্চ চেয়ার। সোফা, চেয়ার
তুর্কিশ ঐতিহ্যের রঙিন ‘কুতনু’ কাপড় দিয়ে গদি
মোড়া । ক্যাফের থাম ও দেয়ালসজ্জায় রাজপ্রাসাদের মোটিফ উদ্ভাসিত। ভাবনা আনতে দ্বিধা
নেই, সুলতানের আমন্ত্রণে অটোমান বৈঠকখানায় কফি পান করতে এসেছি। তিনজনই দেয়ালঘেঁষে পাতা
টানা অনুচ্চ সোফায় বসেছি, পাশাপাশি।
বিকেলের ম্লান আলোয় ইতিহাসের ভুগোলে বসে
আমি সহস্র বছরের মানসভ্রমণ করছি। এ মূহুর্তে মনে জাবর কাটছে কয়েকদিনের কোনিয়া। সত্যি,
এই বিকেলে শহর থেকে দূরে সল্ট লেকের কমলা রঙের বিরলপ্রজাতির ফ্লেমিঙ্গোঝাঁক আকাশে ডানা
মেলেছে। এদের পাখার শব্দ কনস্টান্টিনোপলের নি:শ্বাস বরসফরাসে আলবাট্রোসদের হার মানাচ্ছে।
কাপাদোকিয়ার পাহাড়গাত্রের গুহাবাড়িতে বসে সূর্যোস্ত দেখার এন্তেজাম করছে কোতুহলী পর্যটক।
হাজার বছরের প্রাচীন গ্রাম সিল্লে ভিলেজ সম্রাট কনস্টান্টিনের মাতা জুলিয়া হেলেনার
প্রতিষ্ঠিত এলেনা টেম্পলে ভিড় করছে সহস্র দর্শনার্থী। আনাতোলিয়ান সেলজুক মাদ্রাসা,
আলাতিন পর্বতে কাঠের ছাদ-থামের বিরল মসজিদ, সহস্রবছরের পুরোনো বাজার বেদেস্তান ও আজিজিয়া মসজিদে এখন উপচে পড়া মানুষের ভিড়।
ইতিহাসের প্রান্তরে বসে আমি নিজের দেশ
থেকে দূর দ্রাঘিমার ভুগোলের কথা ভাবি, তার্কিশ কফিতে দিই সুখের চুমুক। ভ্রমণবন্ধু তুবা
হিলাল শোনায় ত্রয়োদশ শতকে মেভলানা রুমির আগমন, বসবাস, দর্শনভাবনা। তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা
আজকের কোনিয়া নগরের অন্দর-হকিকত। পাশে বসে ভ্রমণসঙ্গী গৃহবন্ধু জলি শুনে যায় ইতিহাসকথা।
বেশি শোনে, বলে কম। কফি আলাপে আমি যতো মুগ্ধ, কফি কথকতায় ততো বিচলিত জলি। নিজের কাপটি
শেষ করে ক্যাভহে হানেসির আরেক দিকে জানালার পাশে হ্রদ দেখায় মনোযোগ দিয়েছে। সেখানে
ভেসে বেড়াচ্ছে এক দল রাজহাঁস। বিস্কুটের গুড়ো ছিটিয়ে এদের জড়ো করার কসরত তার। মোবাইল ক্যামেরায় যদি একটি ভাল ছবি তোলা যায়। এমনই
তার মন, ফুল আর প্রাকৃতিক শোভা দিলে আর বাস্তবে থাকে না, অনন্তে হারিয়ে যায়।
আমার কফি আমন্ত্রিত ভাবে গদ গদ। অথচ প্রথম
চুমুকে আমি আঁতকে উঠেছি। রসনায় যেন কেউ ঢেলে দিয়ে গেছে কল্পনাথের রস। পুরো মুখ তেতোর
তেতো।
তার্কিশ
কফির নাকি এতো সুনাম! মুখ তো পুরো তিতে হয়ে গেল !
সাহেব, নানারকম
কফি আছে তুর্কি দেশে। এই কফি চিনি ছাড়া, এর গুণ তুলনাহীন। সুলতানরা রাত জাগার জন্য
কালো কফি এন্তার পান করতো। সারা দুনিয়া ‘আমেরিকানো’ পোশাকী নামে
এটা চালানোর চেষ্টা করে, তার্কিশ কফির মতো হয় না।
আমার মুখ তেতো হলেও কফিকথক মিষ্টভাষী,
সে বলে যাচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি কথা। জিহ্বায় কল্পনাথের রস, কানে মধুকন্ঠের অনুভূতি।
আমাদের পাশাপাশি বসার অবস্থান থেকে জলিকে
স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সে আছে মেতে ভাসমান হাঁসে । কফিকথন তুঙ্গে ওঠে। কফিকথক আরও
মগ্ন হয়ে কফিসংস্কৃতি বুঝিয়ে চলেছে, ঘনিষ্ঠ মুগ্ধ শ্রোতা। আলাপ আরেক কদম এগিয়ে যায়
এই কথায়-
তার্কিশ প্রবাদে
আছে, কফি হতে হবে জাহান্নামের মতো কালো। ভালোবাসার মতো মিষ্টি। অতএব আজকের কালো তেতো
কফি ভালোবাসার মতো মিষ্টি।
তাই নাকি? বলো
কী?
মাঝখানে আছে আরেকটি
বাক্য- কফি হতে হবে মৃত্যুর মতো দৃঢ়।
এসব শুনে কফিপাঠ ভালই হলো বলে যখন ভাবছি,
তখনও শেষ হয়নি। চমক অপেক্ষা করছে আরও।
কফিপর্ব শেষে আমারটিসহ নিজের কাপ ঝট করে
উল্টে ফেললো তুবা। আবার কাপটি সস্থানে রেখে ‘ওস্তাদের মাইর
শেষ রাত্রি’র মতো কিছু কথা-
দ্যাখো, কাদাসদৃশ
তলানি কাপের ভেতরে তৈরি করেছে বহুরৈখিক শিল্প। তুর্কিরা বিশ্বাস করে এর মধ্যে আছে তাদের
ভুত ভবিষ্যত। বিয়ে থা’তে কনের কফি ক্যারিশমা এক বড় ফ্যাক্টর।
কফি বানানোয় আমি পটু না। বিয়েতে আমার আগ্রহ নেই। কফি কাপের রিডিংও সেরকম। তোমার কাপে
দেখছি, ভ্রমণ সফল, ফলপ্রদ।
‘এতোক্ষণে অরিন্দম
কহিলা বিষাদে’- শুরুর সংলাপ খোলাসা হলো এবার। মামুলি এককাপ কফি খেতে
বসে তাল তাল কথায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার। আলাপে বুঝলাম, কপি কাপ রিডিং বলে একটা
বড় ব্যাপার আছে তুর্কি স্ংস্কৃতিতে। এ মুলুকে স্বনামখ্যাত পেশা ‘কফি কাপ রিডার’। কফিকাপের রেখা
পড়ে ভাগ্যগণনা করতে পেশাদাররা রীতিমতো বড় বড় অফিস খুলে বসেছে মুলুকজুড়ে।
ভাসমান হাঁসকে বিস্কুটের গুঁড়ো খাওয়ানোর
ছুতোয় জলিই বা কতোক্ষণ দূরে থাকে? এরই মধ্যে সে ফিরে এসে বসেছে পূর্বস্থানে। এবার ওঠার
পালা। বেরুতে উদ্যত হতেই শেষ কামানটি দাগলো বাতাসে-
‘বীর ফিনঝাঙ কাভহেনিন
কির্ক ইল আতিরি ভার্দের’
বীর, কাভহেনিন কোনটাই না বুঝে আমি আর জলি
একসঙ্গে তাকাই কোনিয়াকন্যা, কফিকন্যার দিকে। পরিস্কার ইংরেজি কানে আসে -
এক
কাপ কফির বিনিময়, কফি মেজবানের জন্য চল্লিশ বছরের বন্ধুতা
আমি তখন লাজুক নীরবতায়, জলির অভিব্যক্তি
দেখার মতো ! #
Comments
Post a Comment