আমার মূসা ভাই




আমার মূসা ভাই

মাহমুদ হাফিজ




আমি ভাগ্যবান। সাংবাদিক হিসাবে সদ্যপ্রয়াত সাংবাদিকতার কিংবদন্তি এবিএম মূসার সান্নিধ্য পেয়েছি প্রত্যাশার চেয়ে একটু বেশি। 
বুধবার দুপুরে আমার প্রিয় মূসা ভাই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার এই চলে যাওয়ায় জাতির অপূরণীয় ক্ষতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চা, সাহসী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আমরা একের পর অভিভাবক হারাচ্ছি। এর সর্বশেষ সংযোজন এবিএম মূসা। মূসা ভাইয়ের প্রয়াণ সাংবাদিক সমাজকে বহুদিন কাঁদাবে বলে আমার বিশ্বাস। জীবদ্দশায় সৎ, নির্ভীক ও পেশাদারি সাংবাদিকতার যে রূপরেখা তিনি রচনা করে গেছেন, তা হয়তো রয়ে যাবে অনন্তকাল।

মূসা ভাইয়ের সান্নিধ্য-স্মৃতি আজ মনের কোণায় ভিড় করছে। ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি আমাকে 'তুই' বলে সম্বোধন করতেন। আজকের বাংলাদেশে খুব কম বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সম্পাদক আছেন, যাদেরকে মূসা ভাই 'আপনি' বা 'তুমি' বলে সম্বোধন করেছেন। 'তুই' বলে যে কাউকে আপন করে নেওয়ার এই অভ্যেসটি তিনি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে। বলাবাহুল্য, আজন্ম বঙ্গবন্ধুভক্ত মানুষটি শেষজীবনে পেশার প্রতি এতোটাই একনিষ্ঠ ছিলেন যে পেশার প্রতিই অনুগত থেকে গেছেন, দলান্ধ দুর্নাম তার গায়ে লাগেনি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সাহস বা সত্যনিষ্ঠতা থেকে বিচ্যূত হননি তিনি কখনোই।
মরহুম এবিএম মূসার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার শুরু একটি সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঘনিষ্ঠতার প্রথম সুযোগটি করে দিয়েছিলেন সাংবাদিকতার আরেক প্রতিষ্ঠান আবদুল তোয়াব খান। ঘটনা ১৯৯৬ সালের। জাতীয় নির্বাচনের আগে ফেনীতে মূসা ভাই একটি রাজনৈতিক জনসভায় ভাষণ দিতে যাবেন। সঙ্গে সাংবাদিক দরকার। তোয়াব ভাইকে বললেন তিনি। তোয়াব ভাই অনেক ভেবে-চিন্তে আমাকে নির্বাচিত করে অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। নির্ধারিত দিনে মূসা ভাই জনকন্ঠ ভবন থেকে আমাকে তুলে নিলেন তার সাদা রঙের স্টেশন ওয়াগন গাড়িতে। চালকের আসনে তিনি নিজেই। প্রেসক্লাব থেকে আমার চেয়ে জ্যেষ্ঠ আরেক সাংবাদিক গাড়িতে উঠলেন। তার নাম জহুরুল ইসলাম। যতোদূর মনে পড়ে তিনি তখন বাংলাদেশ টাইমসে কাজ করতেন। জহুর ভাই কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন।
মূসা ভাইয়ের সঙ্গে যাত্রা করে আমরা দুপুরের মধ্যেই ফেনীতে পৌঁছালাম এবং তার এক ভক্তের বাড়িতে মধ্যাহ্ন আহার সেরে জনসভাস্থলে গেলাম। পরিকল্পনামাফিক জনসভা শেষে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। এ যাত্রা খুব স্মৃতিময় এ কারণে যে, ফেরার পথে আমরা পড়ি মারাত্মক এক সড়ক দুর্ঘটনায়। ঢাকার উদ্দেশে মূসা ভাই গাড়ি ড্রাইভ শুরু করেছেন। আমি তার পাশের আসনে। জহুর ভাই পেছনে। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা পার হয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়েক। ঢাকায় ফিরে পরের দিনের কাগজে সংবাদ ধরানোর তাড়া আমাদের। স্টিয়ারিং হাতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছেন মূসা ভাই। হেডলাইটের আলো সামান্য দূরে যাই। আরো দূরে দেখার জন্য তিনি মাঝেই মাঝেই 'ডিপার' (দূরে আলো ফেলার কৌশল) দিচ্ছেন। আমাকে বলছেন, সামনে দেখিস। আমি বেশি দূরে খুব ভালো দেখতে পাচ্ছি না।
গাড়ি তখন ফেনী বাইপাস সড়কে। আকস্মিক দৃষ্টিবিভ্রমে মুহূর্তে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। শত কিলোমিটার গতির মধ্যেই আমাদের গাড়ি সড়ক বিভাজনের ওপর উঠে গেল। এমনকি চার চাকা উঁচু অবস্থায় আমাদের নিয়ে চললো অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। মুসা ভাই সজোরে ব্রেক চাপলেও তা কাজ করছিল না। শেষমেষ কয়েকশ' গজ দূরে গিয়ে বিভাজনের আরেকবার ধাক্কা দিয়ে গাড়ি বন্ধ।
ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি, তিনজনই গাড়ির মধ্যে নেতিয়ে। আমি অপেক্ষাকৃত কমবয়সী বলে দ্রুত পরিস্থিতি সামলে কিছুক্ষণের মধ্যে ধাতস্ত হলাম। একদম আশপাশে লোকজন নেই। ঠাসা অন্ধকারে কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। দু'পাশ দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি ছুটে গেলেও সাহায্যের জন্য কেউ দাঁড়াচ্ছে না। প্রথমে আমি বেরিয়ে মূসা ভাই আর জহুর ভাইকে ধরে গাড়ি থেকে বের করলাম। দেখি মূসা ভাইয়ের হাত পা কাঁপছে। বেশ খানিকটা দূরে দোকানপাট ছিল। চিৎকার চেচামেচিতে অদূরের দোকান থেকে দুয়েকজন ছুটে এলো। আমাদের ধরাধরি করে রাস্তার পারে দোকানে নিয়ে গেল। গাড়িটি ভচকে চলার উপযোগী নেই। মুসা ভাইয়েরও আর চালানোর মনোবল নেই। এ বিপজ্জনক সময়ে আমি তার তত্ত্বাবধান করতে লাগলাম।
পরে আধ ঘন্টা বিশ্রাম ও প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর ঠিক হলো, সেখানকার একটা দোকানের সামনে গাড়ি ফেলে আমরা অন্য ব্যবস্থায় ঢাকা ফিরবো। রাতে লোকজন আমাদের ঢাকামুখী বাসে উঠিয়ে দিলেন। বাসে কোনো আসন ফাঁকা না থাকলেও যাত্রীরা মূসা ভাইকে চিনে আসন ছেড়ে বসার ব্যবস্থা করলেন। আমি আর জহুর ভাই ঢাকার পথের বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে রইলাম।
বিপদদিনের এই স্মৃতি আমাকে মূসা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ একজনে পরিণত করেছিল। পেশা, জীবন-যাপন বৈষয়িক অনেক বিষয়ে তিনি আলাপ করতেন, পরামর্শ নিতেন, দিতেন। পেশাকে কিভাবে সমুন্নত রাখতে হবে সে ব্যাপারে উপদেশ দিতেন।
এই সময়েই সাংবাদিক খান মুহম্মদ সালেক এটিএন বাংলায় সেকাল একাল নামের একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকতা বিষয়কে মূল বিষয় করতে চাইলেন। খান সালেকের টিভি জীবনে আসার পেছনে আমার একটা ভূমিকা ছিল। তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমাকে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমন্ত্রণ জানাতেই সেকাল বা অগ্রজ সাংবাদিক হিসাবে মূসা ভাইকে নিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির হলাম। প্রয়াত সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খান আর মূসা ভাই একদিকে বসলেন, আমি আর জামালউদ্দিন বসলাম একালের টেবিলে। আলোচনা বেশ জমে উঠেছিল।
জাতীয় প্রেসক্লাবেই মূসা ভাইয়ের সঙ্গে বেশি দেখা হতো। তার সঙ্গে বহু বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হতো। তিনি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক বিষয় খোলাসা করতেন। সব ইস্যু ও আলোচনায় তার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতো। অনেক ক্ষেত্রে তা অন্যদের থেকে আলাদা। তবে তা অন্য কারো সঙ্গে না মিললেও তা চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তিনি পোষণ করতেন না।
কয়েক মাস আগে অসুস্থ মূসা ভাইয়ের সঙ্গে প্রেসক্লাবে দেখা হলো। সঙ্গে তার কন্যা পারভীন সুলতানা ঝুমা। আমি মূসা ভাইকে বললাম, আমি আপনার বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিতে চাই। তিনি পাত্তাই দিলেন না। বললেন, ‘আরে বাদ দে, এসবের আর এর প্রয়োজন নেই’। বুঝলাম, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাতর মূসা ভাইয়ের আর সাক্ষাৎকার প্রকাশের কোনো আগ্রহ নেই। তিনি তখন হয়তো ভেতরে নিয়ে নিচ্ছেন জীবন সায়াহ্নের প্রস্তুতির।
মাহমুদ হাফিজ: লেখক, সাংবাদিক

বাংলানিউজ ২৪ ডটকমে প্রকাশিত। লিংক নিচে: 

http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/281317.html


Comments

Popular Posts